|
নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া পৌর সদর থেকে সোজা উত্তর দিকে কেন্দুয়া নেত্রকোণা সড়ক ধরে অগ্রসর হলে চোখ পড়বে সাউদপাড়া মোড়। মোড় পেরিয়ে প্রায় আড়াইশ গজ পথ পাড়ি দিলে পরিলক্ষিত হবে একটি শাখা সড়ক। সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এ পথ ধরে একটু এগুলেই মৃত রাজেশ্বরী বা রাজী নদীর ওপর ছোট্ট একটি ব্রীজ। ঐ ব্রীজটি পেরুতে না পেরুতেই বামপাশে একটি হাজা মাজা পুকুর নজরে আসবে। এতে তৎকালিন তালুকদার বাড়ীর শ্বারদীয় পূজার প্রতিমা ঘটা করে বিসর্জন দেওয়া হতো। ঐ পুকুরের পশ্চিম পাড়ে চন্দ্রকুমার দের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম আইথর ও তালুকদার মহাশয়দের ও তার বংশ ধরদের বসতবাড়ী। ঐ বাড়ীটি যদিও চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত দালান কোঠায় ভরপুর না থাকলেও দু একটি দালান ছিলোনা যে, তা নয়। পরিপাটি করা টিনের ঘরগুলো বিন্যস্থ সারিবদ্ধ ফলজ বনজ বৃক্ষাদির সমারোহ ও ভেতরকার মহল পুকুরগুলো উঁচু মাথায় তালুকদার বাড়ী ঐতিহ্য বহন করে আসছিলো। পরিতাপের বিষয় বর্তমানে জ্বরাজ্বীর্ন দুর্দশাগ্রস্থ বাড়ীটি বাবুদের দৌরাত্বের ও মহত্ত্বের প্রতিচ্ছবি ললাটে ধারন করে আজও কালের সাক্ষী হয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে যাচ্ছে। বাবুদের সম্মানী নীতিতে নিষিদ্ধ ছিলো কোন পথিক জুতো পায়ে ছাতা মাথায় বাড়ীর আঙিনায় ঢুকতে পারবে না। ঢুকলে তাকে শাসনের আওতায় পড়তে হতো। তাই লোকজন জুতো আর ছাতা বগলে ধারন করে ভয়ে ভয়ে বাড়ীর আঙিনা পাড়ি দিয়ে আবার নতুন করে সৎ সাহসে জুতো ছাতা ব্যবহার করে পথ চলত। বাবুদের কৌলিন্নতা বজায় রাখতে রাস্তার পাশে গরু কোরবানী করতে দেওয়া হতো না। নমনীয় নীতি ছিল পূজা পার্বনে বা নতুন বছরে প্রজাদিগকে ডেকে এনে এক জোড়া করে নারকেল ও কিছু পাসাদ বিতরন করতেন। সন্তোষ্ট হয়ে প্রজাগণ বাবুদের সালাম ঠুকে জয় কির্ত্তন করতে করতে বাড়ী ফিরতো। এই তালুকদার বাড়ীর পাশেই এক দরিদ্র সাধারন পরিবারে ময়মনসিংহ গীতি কাব্যের গাঁথা সংগ্রহকারী লেখক চন্দ্র কুমার দে জন্ম গ্রহন করেন। ঐ প্রতিভাবান ছেলেটি হয়েছিল একদিন বাবুর চক্ষুশূল। অবশ্য এর একটি কারনো রয়েছে। তারা ছিলো বাবুদের ভিটে বাড়ীর প্রজা ও দরিদ্র। দরিদ্র পরিবারের ছেলে বলে পড়া লেখায় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি। দরিদ্রতার নির্মম কষাঘাতে নিষ্পেষিত হলেও বিদ্যাদেবী তাকে ছাড়েনি। অল্প বেতনে তারানাথ সেন গুপ্ত বাবুর মহলে খাজনা আদায়ের চাকুরী নিয়ে, চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতির জ্ঞান ভান্ডার থেকে জ্ঞান আহরন করে গাঁথা সাজিয়ে ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকার পাতায় ঢুকিয়ে দেন। যা তাকে সেন বাবুদের সম্মানের চাইতেও অধিক সম্মানের উচু আসনে বসিয়েছিল। কথিত আছে তৎকালীন সময় জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাহিত্যিক হিসেবে চন্দ্র কুমার দে‘কে সম্মর্ধনা অনুষ্ঠানের ফুলের তোরা দিয়ে মুহু মুহু করতালির মাধ্যমে বরণ করতে গেলে, পাশে বসে থাকা ঐ বিদ্যালয়ের সদস্য সেন বাবু লজ্জায় মাথা হেড করে বসে থাকেন। মঞ্চে যখন দরিদ্র বর্ণহীন লোকটির প্রশংসার প্রজাপতিটি চারদিক মুখরিত করে উড়েছিলো। ঈর্ষানলে দগ্ধ বাবুটি যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে এক সময় আসন খালি করে চলে আসেন। আইথর গ্রামের রত্ন ছিলো চন্দ্র কুমার দে। তারই গাঁথাগুলো বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে আজ শুধু চন্দ্র কুমার দে‘র কেনো, শুধু আইথর কেনো, সারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এটি বাংলাদেশের কম গৌরবের কথা নয়? বড়ই আফসোস, এ প্রখ্যাত নামী দামী লোকটির জন্মস্থান আইথরে কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। মুখে মুখে যা কিছু চন্দ্র কুমার দে স্মৃতি পরিষদ নামে কেন্দুয়া সদর একটি সংগঠন আইথর গ্রামে স্মৃতিফলক স্থাপন করার জন্য সরকার কর্তৃক অনুদান প্রাপ্ত হয় এবং এর ভিত্তি প্রস্তর ও স্থাপন করা হয়। দুঃখের বিষয় কেন্দুয়া সদর থেকে সংগঠনটি কোথায় হাওয়া হয়ে যায় এবং ভিত্তি প্রস্তরের ইটগুলো পর্যন্ত হারিয়ে যায়। ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালিতে তার সমাধির উপর শক্ত মজবুত রঙ্গিন সিমেন্টের ছাতা ছিল যা তার স্মৃতি বহন করত। ১৯৭১ সনে পাকবাহিনী ভেঙ্গে নিশ্চিন্ন করে দিয়েছে এটি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আমি জোর দাবী জানাচ্ছি আইথর গ্রামে এই মহামানবটির স্মৃতি রক্ষার জন্যে। আইথর গ্রামটি পূর্বমুখী প্রায় ১ কিঃ মিঃ বিস্তৃত। গ্রামের সম্মুখ দিক দিয়ে একটি রাস্তা কেন্দুয়া সদর উপজেলায় প্রবেশ করেছে। গ্রামের বাড়ী ঘর, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ গাছগুলি অতেন্দ্র প্রহরায় গ্রামের শোভাবর্ধন করে চলছে। অমন সারিবদ্ধ ছায়া সুশীতল গ্রাম অন্য কোথায় নেই। ব্রিটিশ রাজত্বকালে কেনো, পাকিস্তান রাজত্ব কালেও এ গ্রামের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কিছু সংখ্যক বিত্তশালী লোক জন ছাড়া তাদের ছেলেদেরকে বাইরের বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করানো সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিছু সংখ্যক বিত্তশালী লোক জন ছাড়া তাদের ছেলেদেরকে বাইরের বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করানো সম্ভাব হয়ে উঠেনি। ফলে শিক্ষার হার ছিলো অতি নগন্য। আর্থিক দুরাবস্থার কারনও রয়েছে। বড় গাছের নিচে থাকা ছোট গাছ যেমন মাথা উঁচু করে আকাশ দেখতে পারে না, তেমনি তালুকদার জমিদারদের গ্রামের লোকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসতে পারে না। অধিকাংশ লোকেরাই দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করত। তবে সবাই যে অস্বচ্ছল ছিলো তা নয়। চাকুরীজীবী, পেশাজীবী ব্যবসায়ী‘ও ছিল, তাও হাতে গুনা। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন মিলে মিশে বসবাস করছে। উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন উভয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভাগাভাগি করে আনন্দ অনুভব করে থাকে। তাদের মাঝে কোন হিংসা বিদ্বেষ দেখা যায়নি কখনো। গ্রামে তিনটি মসজিদ একটি ঈদ‘গা ও একটি হাট রয়েছে। হাট‘টি বাবুদের নামে সেনের হাট নামে পরিচিত। ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিগন মসজিদে নামাজ আদায় করেন। বাবুদের বাড়ীতে একটি সুন্দর পরিপাটি করা মন্দির ছিলো। তাও আজ ধ্বংসের পথে। তবে গ্রামের মাঝে একটি ঠাকুর ঘর রয়েছে তথায় হিন্দুগন পূজা অর্চনা করে থাকে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটি খাল, দক্ষিনাংশে একটি রাস্তা গিয়ে গ্রামটি তিন পাড়ায় বিভক্ত - উত্তরপাড়া, মাঝপাড়া ও ভাটীরকোনা। খালের উপর ব্রীজ থাকায় যাতায়াতের কোন অসুবিধা নেই। এবং সার্বিক যোগসূত্র ও রয়েছে। আইথর গ্রামের লোকজন খুব নিরীত শান্ত প্রিয় অন্যান্য গ্রামের লোকদের তুলনায়। বড় ধরনের কোন ঝগড়া ঝাটি হতে দেখা যায় না। তাই আইন বা থানা পুলিশের কাছে আসতে হয় না। ছোটখাটো ঘটনা স্থানীয় মুরব্বীগন তাৎক্ষনিক সুষ্ঠ ফয়সালা দিয়ে থাকেন। ফলে গ্রামবাসী আরামআয়াশে বসবাস করে।
১৯৯০ সালে মরহুম আঃ হাই সরকার বাচ্চু ও তার বড় ভাই এম.এ হামিদ জিলু স্যারের সার্বিক প্রচেষ্টায় সেনের বাজারের সংলগ্ন নিজস্ব অর্থায়নে, নিজস্ব ৫০ শতাংশ জমির ওপর আঃ হাই স্যার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থেকে আরও ৩ জন শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়ে দু চালা টিনের ঘরে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করলে কিছুদিন পর এটি এমপিওভুক্তিতে দালানে রুপান্তরিত হয়ে বর্তমানে বিদ্যালয়টি সরকারি করণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ফলে গ্রামের প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। আঃ হাই সাহেবের মৃত্যুর পর জেসমীন আরা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে বিদ্যালয়টি সুষ্ঠ ও সুন্দর ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার এম. এ. জলিল সাহেবের এক ছেলে ডাক্তার, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার। পিতা পুত্র তিনজনই প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার, যা বিরল। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এম. এ. হামিদ সাহেবের পরিবার ৫/৬ জন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিল, আছে। দুইজন পুলিশে কর্মরত, আরেকজন বেসরকারি প্রজেক্টে কর্মরত, আরেকজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি। এক ছেলে অনার্স পাস করে মাষ্টার্সে অধ্যয়নরত। একই পরিবারের আরেক ছেলে অনার্সে অধ্যয়নরত। তাছাড়া গ্রামের অন্যান্য পরিবারেও দু‘একজন শিক্ষক ও আই.এ, বি.এ পাশ করে ছেলে বেকার রয়েছে। গ্রামটি বহুলাংশে কৃষির উপর নির্ভরশীল। আঃ হক মিয়া একজন নাম করা কৃষক। তার সবজী বাজার জাত করে ঘরে কাচা পয়সা তোলে প্রতিদিন।
চন্দ্রকুমার দের সাহিত্য চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গ্রামের কতকজন সাহিত্য অঙ্গনে বিচরন করেছেন। এম. এ. জলিল সাহেবের প্রকাশিত "বাংলাদেশ একটি অনন্য পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র" ভ্রমন কাহিনীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের মনোরম দৃশ্যাবলী পাঠক হৃদয়ে জাগ্রত থাকবে। গ্রামের নাট্যকার ও উপন্যাসিক মোঃ চাঁন মিয়া সাহেবের লিখিত "মনি মুক্তা" ও "নদীর ঘাটে বলি" নাটক দুটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। "দু ফোটা চোখের পানি" লেখকের আরেকটি বহুল প্রসংসিত উপন্যাস। এম. এ. হামিদ জিলু সাহেবের অপ্রকাশিত উপন্যাস "অব্যক্ত ব্যথা", "প্রেমের জয়" ও "সাগরের ঢেউ" একদিন পাঠক হৃদয়ে ছুঁয়ে যাবে বলে লেখকের বিশ্বাস।
এই দিক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গ্রামটি সাহিত্য অঙ্গনে বিজয় মুকুট মাথায় ধারন করে স্বগৌরবে অত্র উপজেলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল।
এম. এ. হামিদ জিলু
অবসর প্রাপ্ত স্কাউট শিক্ষক
উত্তর কেন্দুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়