আফজালুর রহমান আমার নাতী। জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সুনামের সহিত পাস করে। বর্তমানে সিলেট শাহজালাল ভার্সিটিতে গণিত বিষয়ে সম্মান ক্লাসে অধ্যয়নরত। সে নাকি ঐ বিদ্যালয়ের কর্তব্যরত স্যারদের নিকট থেকে অনুমতি সাপেক্ষে জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়'এর জীবন বৃত্তান্ত শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত শিক্ষক সৈয়দ আবু সাদেক স্যারের লেখাটি ইন্টারনেটে প্রেরণে প্রয়াসী হয়। যেহেতু আমিও ঐ বিদ্যালয়ের এক-কালীন ছাত্র ছিলাম। সে সুবাদে আমাকেও ঐ বিদ্যালয় সম্পর্কে একটি লিখা দিতে আমায় অনুরোধ জ্ঞাপন করে। তার ঐ অনুসন্ধিৎসু মানের যোগান দিতে গিয়ে আমাকে ১৯৫২-৫৩ সন থেকে ১৯৬০ সন পর্যন্ত পেছনে গিয়ে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নরত সময়টুকু স্মৃতির পাতা থেকে আহরণ করে কিছু লিখার প্রয়াসী হলাম। ভুল ভ্রান্তিতে পাঠক যেনো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি মেলেন।
ঐতিহ্যবাহী জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়টি কেন্দুয়া উপজেলার সদর প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রয়াত জনাব আবু সাদেক স্যার জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর লেখনিতে বিষদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই ঐ দিকে আমি আর আলোকপাত করতে চাইনা।
খুব সম্ভব ১৯৫২ কিংবা ১৯৫৩ সনে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে দেখতে পাই ভিটি পাকা কাঠের খুঁট, চার দিক টিনের বেড়া "এল" (L) পেটার্ন বারান্দা সহ চৌচালা টিনের ঘর। শ্রেণী কক্ষের পার্টিশন গুলো ও সিলিং ছিল চাটাই বিশিষ্ট বিদ্যালয় আঙ্গিনার পূর্ব প্রান্তে একই অবস্থার বড় একটি চৌচালা টিনের ঘরে পশ্চিম মুখী ছিল। এতে অর্ধেকটিতে দশম শ্রেণীর ক্লাস বসত। বাকী অর্ধেকে অফিস কক্ষ, প্রধান শিক্ষক কক্ষ, স্টাফ রুম ও একটি লাইব্রেরী ছিল। চতুর্দিকে পরিপাটি করা কাঁটা মেন্দীর বেড়া ছিল। যা মনে হত - সবুজ গালিচা পাতা একটি সরু হাই রোড, বিদ্যালয়টিকে ঘিরে আছে। এটি কার চোখ না কাড়তো। যেকোন পথচারী এটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। দপ্তরী মনিন্দ্র দা‘র সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বিদ্যালয়টি সর্বদা ঝলমল করত। গ্রীষ্মের প্রচন্ড কড়ায় ছাত্রদের তৃষ্ণায় ছাতি কাপতো, মনিন্দ্র দা তখন এক হাতে পানি ভর্তি জগ অপর হাতে গ্লাস নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে ছাত্রদের তৃষ্ণা মেটাতো।
নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত দপ্তরী সোনাকর ভাই'এর কথা মনে হলে এখনো হাসি চেপে রাখতে পারিনি। বেচারা ছিল খুব সরল সোজা। বেলে, কাঠের হাতুরীটি এত কম জোরে আঘাত করত, শব্দই ওঠতো না। জিজ্ঞেস করতাম - “কি হে সোনাকর ভাই জোরে বেল বাজাতে পারোনা?” উত্তরে বলতো - “তোমাদের কথায় জোরে বেল বাজালে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাক, শেষে সারা বছর বিনে পয়সায় খেটে এর ভর্তুকি দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরি?” কত সরল ছিল বেচারা!
তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন... এ মুহূর্তে উনার নামটি আমার মনে পড়ছেনা। তবে ছত্রিশ বাবু বলে খ্যাত ছিলেন। ক্লাস শুরু হতেই ধূতির গোছাটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকায়ে পাম্প-সো পায়ে ধীর পদক্ষেপে বারান্দা দিয়ে ক্লাস পরিদর্শন করতেন। কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তিনি নিজেই অভাব টুকু পূরণ করতেন। ফলে শিক্ষকগণ সতর্কতায় পাঠ দান করতেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর চৌকাঠ পেরুতে না পেরুতেই উনাকে আর দেখতে পেলামনা। প্রয়াত জনাব আঃ রহমান স্যার স্থলাভিষিক্ত হয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তিনিও ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর পরিচালনায় বিদ্যালয়টি উত্তরোত্তর উন্নতির সোপান পেরুতে থাকে। প্রয়াত জনাব নূর উদ্দিন মল্লিক স্যার, উনি আমাদের ইংরেজী ও ভূগোল বিষয় পড়াতেন। কঠিনে কোমলে গড়া ছিল তাঁর চরিত্র। অমন শিক্ষক আজ কাল বিরল। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি বাবু যোগেশ চন্দ্র রায় মহাশয়ের কথা। তিনি ছিলেন সব স্যারদের স্যার। খুবই অমায়িক শিক্ষক ছিলেন। আজও মনে পড়ে প্রয়াত জনাব ছামেদ হোসেন স্যারের কথা। তিনি উকিল স্যার নামে পরিচিত ছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন তিনি। ইতিহাসের কথা গুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করে বুঝাতেন, যা ইংরেজী শিখার সহায়ক হত। শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আবু সাদেক স্যার। তিনি বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। তাঁর হাস্যরস মুখের ক্লাস গুলো আমাদেরকে মুগ্ধ করতো। বাবু দুর্গাদাস রায় অংক পড়াতেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। উনার সাক্ষাতে এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। শরীর চর্চা শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আতিকুর রহমান আতিক স্যার। তিনি খুব ভদ্র ছিলেন। ইসলাম ধর্ম পড়াতেন মৌলভী স্যার। হিন্দু ধর্ম পড়াতেন এক পন্ডিত মশাই। তাঁদের নাম আমার স্মরনে আসছেনা। সব প্রয়াত স্যারদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং জীবিত স্যারের সুস্ব্যাস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
বিদ্যালয়টি শুধু পড়া লেখায় উন্নতি করেছিলো তা নয়। খেলাধুলায়, সাহিত্য চর্চায়ও যথেষ্ট নাম ডাক ছিলো। ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় অনেকবার বিজয়ী শীর্ষ তালিকায় নাম ওঠেছে। বৎসর শুরুতেই জনাব মল্লিক স্যারের তত্বাবধানে নাটক ও জনাব আবু সাদেক স্যারের তত্বাবধানে কবিতা আবৃত্তি আরও নানাবিধ আঙ্গিকে বিদ্যালয় আঙ্গিনায় রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে অনুষ্ঠানে দর্শকদের বাহবা কুড়িয়ে নিত। ১৯৬০ সনে আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। এটিই ছিল আমার মাধ্যমিক শিক্ষার শেষ সোপান। এ সময় “শতদল নাম্নী” এক ছাত্রী এ ক্লাসে ভর্তি হয় এবং তারই ছোট বোন “পঞ্চী নাম্নী” ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। তারা ছিল জনৈক সার্কেল অফিস্যারের মেয়ে। জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ে তারাই ছিল প্রথম মহিলা ছাত্র (ছাত্রী)।
আই. এ. পর্যন্ত পড়া লেখা করে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে জড়িয়ে নেই। কাব প্রশিক্ষণ শেষে কাব লিডার হয়ে উত্তর কেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসি। তখন মোহাম্মদ আলী স্যার ছিলেন জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কাউট শিক্ষক। স্কাউটিং প্রোগ্রামে মাঝে মধ্যে এ বিদ্যালয়ে আসতাম। প্রথম দিন বিদ্যালয় পরিবেশ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আনন্দে ও গর্বে আমার বুকটি ভরে যায়। তিন পায়া চেয়ার, ভাঙ্গাচুরা বেঞ্চ-টেবিল, টিনের ঘরের কাঙ্গাল পরিবেশে আমরা পড়ালেখা করেছি। আজকের প্রজন্ম সরকার নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ে মেন্দী কাটার বেড়ার পরিবর্তে সু-উচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত, রাজকীয় ফটক, দামী দামী আসবাব পত্র সহিত বহুতল বিশিষ্ট ভবনে বৈদুতিক পাকার মিষ্টি হাইয়া, চোখ ঝলসানো বৈদুতিক আলোর পরিবেশে পড়ালেখা করছে। সত্যি এরাইতো ভাগ্যবান। বিদ্যালয়টির উন্নতি কামনা করছি।
এম. এ. হামিদ জিলু
অবসর প্রাপ্ত স্কাউট শিক্ষক
উত্তর কেন্দুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়