রোজকার মতো ক্লাসের পড়া নিয়ে ব্যস্ত। রাতের প্রতি খেয়াল নেই তার। চেয়ে দেখে দেয়াল ঘড়িতে রাত বারটা বাজে বাজে প্রায়। বই গুলো গোছ গাছ করে, মশারীটা খাটিয়ে, লাইটটি অফ্ করে সটাং বিছানায় গা টি এলিয়ে তন্দ্রাবিভোর হয়ে পড়ে মিষ্টি। অমনি খট্ করে ঘরের ভেতর একটি শব্দ তোলে আবির্ভূত হয় এক ছায়ামূর্তি। মিষ্টির তন্দ্রা টোটে যায়। চোখ মেলে দেখে- কালো কাপড় আচ্ছাদিত এক অদ্ভূত ছায়ামূর্তি। ভয়ে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার। দুই হাতে চোখ বন্ধ করে সজোরে চিৎকার দিতে উদ্দ্যত হলে, চামচিকার মত সরু হাত বের করে, “চিৎকার দেবেনা মিষ্টি। ভায়ও পাবে না। আমি তোমার কোন ক্ষতিও করবনা।” সাহস পায় মিষ্টি- “কে তুমি? আমার নামই বা জানলে কি করে? আর কেনই বা এসেছ তুমি?” জানতে চায় মিষ্টি। “এসেছি শুধু দুটো কথা তোমাকে জানাব বলে।”
: কোন কথা? আর কেনই বা তা আমাকে জানাতে।
: হ্যা, দরকার আছে বলেই তো তোমাকে জানাতে এসেছি।
: ঠিক আছে। বলো, অমন কী কথা আছে।
: শুনে অবাক হবে না তো? অবাক হবারই কথা। তবু তোমাকে শুনাবো। ভয়ে সর্বাঙ্গ মিষ্টির কাঁপছে। তবু তা শুনার জন্যে আড়ি পাতে সে।
: তবে শুনো। দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছে বলে যার মৃত্যুটা তোমার মা ঢেকে দিয়েছে। সেট আমিই। তোমার বাবা।
: কী বললে! তুমি আমার বাবা। মিষ্টির সাহস বেড়ে যায়। গা-টা জ্বারা দিয়ে বসে। তা হলে কী তুমি দেনার দায়ে বিষ পানে আত্মহত্যা করোনি?
: না।
: তাহলে, অন্য কেও কী তোমায় হত্যা করেছে?
: তাও না।
: কেন মরতে গেলে? তুমি কী একবার ভবলে না আমার কথা? আমিই তো তোমার এক মাত্র মেয়ে ছিলাম। তুমি হাতে তোলে না খাইয়ে দিলে আমার খাওয়া হতো না। আদর করে ঘুম না পাড়ালে আমার ঘুমই হতো না। তুমি-না শখ করে আমার নাম মিষ্টি রেখেছিলে। কেনো তুমি অমন কাজ করলে বাবা?
: কেন যে করলাম মা – তাইতো বলতে এলাম। তোর মা-র কত গুলো নোংরা দৃশ্য আমার অন্তরকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিলো। এগুলোই আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে পারলাম না মা। এ ছাড়া আর বিকল্প কোন উপায় ও আমার জানা ছিলোনা।
: তা হলে কী তুমি স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করনি?
: না।
: তবে?
: এর উত্তর আমি অন্য একদিন দেব – মা। আজ থাক। এ বলে ছায়া মূর্তিটি শূন্যে মিলিয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মিষ্টি।
আজ কামনার বাসর শয্যা। সারা দিন খেটে খুটে কী সুন্দর করে পালঙ্কটি সাজিয়েছে কামালের ছোট বোন রীতা। যেখানে যে ফুল শোভা পায় সেখানেই তা গুজে দিয়েছে। পালঙ্কটি যেন এক অপরূপা নব মালঞ্চ। রীতার রুচি আছে, বলতে হবে। যে দেখে সেই রীতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে রীতা ভাবছে, কিছুক্ষন পরই, ভাই-ভাবীর উষ্ণ নিশ্বাসে সতেজ ফুল গুলো নিস্তেজ ঝরে পড়বে মাটিতে। কী এক অজানা ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় মুচকি হেসে এস্থান পরিত্যাগ করে রীতা। যথা সময়ে কামনা বাসরে এসেছে। বাসরের এক কোনে বসে, অভিনব সাজ সজ্জায় সজ্জিত বাসরটি দেখে তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো। সব মেয়েরাইতো অমন একটা দিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনে। একটু আগেও রীতা অমন একটা অনাগত দিনের প্রত্যাশায় মুচকি হেসে আনন্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তবে কামনা কেনো অমন একটি মধুময় রজনী পেয়েও অশ্রু ঝরাচ্ছে। কী ব্যথা তার মনে? কত কল্পনার জাল বুনতে বুনতে বাসরে প্রবেশ করল কামাল। কামনার চোখে জল দেখে অবাক হয়ে যায় সে। একী কামনা, এ সময় তোমার চোখে জল? এখনও কী পুর্ব স্মৃতি ভুলতে পারনি তুমি? ভুলতে পারনি সেই হারিয়ে যাওয়া লোকটির কথা? তাই যদি হয়, কেন আমায় ভালবেসে পূনঃ বিয়ে করলে? কেনো মিথ্যে অভিনয়ের জালে জড়িয়ে আমায় পাগল করলে? যে জন্য একটি লোককে আত্মহুতি দিতে হলো। একটি মেয়েকে হতে হলো সারা জীবনের জন্য পিতৃহীন। কী দরকার ছিলো এই নাটকের? এ নাটক না করলেও তো পারতে? চোখের জল মুছতে কামনা, কামালকে কাছে টেনে, “কেন এতো অবুঝ হচ্ছো কামাল, কে বলল আমি পূর্ব স্মৃতি স্মরিয়ে কাঁদছি আর এ-ও কী করে বুঝলে, একটি পিতৃহীন বালিকার জন্য কঁদছি। ড্রাগাশক্তি পুরুষটির জন্য কাঁদতে আমার বয়েই গেছে। কোন ভাগ্যের ফেরে সে আমার স্বামী হয়েছিল। আর কোন ফাঁকেই বা মেয়েটি গর্ভে এসেছিল বুঝতে পারিনি। ওদের জন্য কাঁদব দূরের কথা, স্বপ্নেও আমি ও কথা মুখে আনিনি।” তা যদি হয় – তোমার চোখে জল কেনো? “তা তুমি বলতে পারো? তুমি বিশ্বাস করো, আর নাইবা করো আমি কাঁদছি শুধু তোমার জন্যে। তুমি হলে তাজা ফুল। আর আমি? আমি হলেম বাসীফুল। বাসীফুল দিয়ে কেউ ফুলদানী সাজিয়ে সৌন্দর্য্য উপভোগ করে। তাই না?”- কামনা বলল। কী আজে বাজে বকছো তুমি, কামনা। এ কথা বলে একটি মধুময় রাত্রির মর্যাদা নষ্ট করে দিলে। কামনার ঠোঁটে ম্লান হাঁসি ফুটিয়ে, “রাখোতো এসব কথা”। তোমার মত অমন একটি হেন্ডসাম যুবক কেন আজ বাসী ফুলের সুবাস নিতে চাচ্ছো? পারতেনা কী একটি তাজা ফুলের ঘ্রান নিয়ে জীবনটাকে ধন্য করতে, গড়তে পারতে একটি সুন্দর সুখময় জীবন। মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে পারতে। না পারবে এখন বন্ধু বান্ধবের নিকট মুখ দেখাতে, না পারবে সমাজে উঁচু গলায় কথা বলতে। তোমাকে আমাকে আঙ্গুল দেখিয়ে লোকেরা টিট্কারী মারবে। পারবে তা সহ্য করতে? কামালের মন পরীক্ষা করার জন্য আবলিলাক্রমে কামনা কথাগুলো বলে গেলো। দেখ কামনা, শরীরটা আমার গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী। এসব টিট্কারী আমাকে কাবু করতে পারবে না। তুমি আমার পাশে থাকলে আমি বিষ খেয়েও হজম করতে পারবো। তুমিই আমার সব ব্যাধির মহোঔষধ। এখনে আমার ভয় হয় কামনা, তুমি চাকুরীজীবী মানুষ। না আছে আমার চাকুরী বাকুরী, না আছে অর্থ-বিত্ত, রাজনীতি করি। এক পা সব সময় চৌদ্দ সিকের ভেতর থাকে। অর্থাভাব তো লেগেই আছে। কখন যে এভাবে আমায় পরিত্যাগকরে চলে যাও কে জানে? কামনাকে পরীক্ষা করার জন্য কামাল কথা গুলো হাঁসি হাঁসি মুখে বলতে থাকে। এ কথা গুলো শুনে ভীষন দুঃখ লাগলো কামাল, কামনা জবাব দেয়। তুমি যে বেকার তা জেনে শুনেই তো তোমায় ভালোবেসেছি। আযথা তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? আমার বেতনের সব টাকাই তো তোমায় দিয়ে দেই। খরচের জন্য তোমার কাছে হাত পেতে নেই। কী, নেই নি? তা অবশ্য। দেখো কামাল, তোমার সুখ আমার সুখ। তোমার দুঃখে আমার দুঃখ। তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই সবসময়। তুমি আমার স্বর্গ। যথার্থই তুমি বলেছ। আমি মুসলমান ঘরের ছেলে। তুমি হিন্দুর দুলালি। এইটুকু ব্যবধান মাত্র। সমাজের কথা বলছিলে – সমাজ তো মানুষের গড়া। যা চালানো যায় তাই চলে। কোন হিন্দু যদি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করে, সে আমাদের সমাজে মর্য্যাদা লাভ করে অমন কী আল্লার দরবারেও। সে নিজে তো বেহেস্থে যাবেই উপোরুন্ত তার মা-বাবাকে ও বেহেস্থ নেবার সুপারিশ জানাতে পারবে আল্লার দরবারে। তোমার হিন্দু সমাজে কি আছে না আছে তা আমার জানা নেই। সত্যি কামাল, তোমার ধর্ম আমার খুবই পছন্দনীয়। আমার বাসার পাশে রোজ সকালে এক মৌলভী সাব তোমাদের পবিত্র গ্রন্থ তেলোয়াত করতেন। আমি তন্ময় হয়ে তা শুনতাম।
হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে। এলাকায় মুখ রোচক গল্প কাহিনী হয়ে বাতাসে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। হাটে, ঘাটে, মাঠে সর্বত্রই এ নিয়ে বলা বলি চলছে। কেহ বলছে ভালই কাজ করেছে। আবার কেহবা বলছে অমন একটা কাজ ওরা করতে পারলো? বাপ দাদার চৌদ্দ গোষ্টির নাম ডুবিয়েছে। নানা মনের নানা মত তো থাকবেই। বিয়ের পর কিছু দিন কামনা বাবার বাড়ী অবস্থান করেছিল। ফলে হিন্দু সমাজে বাবাকে এক ঘরে করা হয়েছে। একটা বড় রকমের ভোজ পর্ব দিলে বাবাকে সমাজপতিরা আবার জাতে ওঠান। এ লজ্জা ঘৃনায় কামনার বাবা ধুকে ধুকে ইহদাম ত্যাগ করেন। বাবার মৃত্যুতে কামনার মনে ভীষণ আঘাত লেগেছে। কিন্তু মুখ ফোটে কাউকে কিছু বলিছেনা। কারন এ মৃত্যুর জন্য কামনা নিজেই দায়ী।
ছায়া মূর্তিটি আসার পর থেকেই মিষ্টি, নানীকে সাথে রেখে ঘুমায়। আজ আমাবস্যার তিথি। নিকুষ কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে গেছে সারা পৃথিবী। গভীর রাতে হঠাৎ ঘরের ভেতর খট্ শব্দ ওঠায় নানীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখেন এক ছায়ামূর্তির আবির্ভাব। আবার মিষ্টির ঘরে এসেছ তুমি, কী চাই তোমার? জানতে চান নানী। আপনি জেগে আছেন, ভালই হলো। মিষ্টিকে জাগাবেন না। মিষ্টি আপনার এখানে আছে বলেই আপনাকে বলা। আপনার মেয়ে যেভাবে একিটা জীবন নষ্ট করেছে, মিষ্টি যেনো অন্য কারো জীবন এভাবে নষ্ট না করে এভাবে তাকে গড়ে তোলবেন, এ আমার মিনতি আপনার কাছে – এ বলে ছায়ামূর্তিটি শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পথে নানী পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
বিঃ দ্রঃ- “এই গল্পটি সম্পূর্ন কাল্পনিক। গল্পটিতে ব্যবহৃত নাম, ঘটনা বা চরিত্র কারো সঙ্গে আংশিক বা পুরোপুরি মিললে লেখক দায়ী নয়।”
[click here to download the story]
লেখক পরিচিতিঃ
এম. এ. হামিদ জিলু।
অবঃ স্কাউট শিক্ষক,
উত্তর কেন্দুয়া সরঃ প্রাঃ বিদ্যালয়।
কেন্দুয়া, নেত্রকোনা।
: কোন কথা? আর কেনই বা তা আমাকে জানাতে।
: হ্যা, দরকার আছে বলেই তো তোমাকে জানাতে এসেছি।
: ঠিক আছে। বলো, অমন কী কথা আছে।
: শুনে অবাক হবে না তো? অবাক হবারই কথা। তবু তোমাকে শুনাবো। ভয়ে সর্বাঙ্গ মিষ্টির কাঁপছে। তবু তা শুনার জন্যে আড়ি পাতে সে।
: তবে শুনো। দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছে বলে যার মৃত্যুটা তোমার মা ঢেকে দিয়েছে। সেট আমিই। তোমার বাবা।
: কী বললে! তুমি আমার বাবা। মিষ্টির সাহস বেড়ে যায়। গা-টা জ্বারা দিয়ে বসে। তা হলে কী তুমি দেনার দায়ে বিষ পানে আত্মহত্যা করোনি?
: না।
: তাহলে, অন্য কেও কী তোমায় হত্যা করেছে?
: তাও না।
: কেন মরতে গেলে? তুমি কী একবার ভবলে না আমার কথা? আমিই তো তোমার এক মাত্র মেয়ে ছিলাম। তুমি হাতে তোলে না খাইয়ে দিলে আমার খাওয়া হতো না। আদর করে ঘুম না পাড়ালে আমার ঘুমই হতো না। তুমি-না শখ করে আমার নাম মিষ্টি রেখেছিলে। কেনো তুমি অমন কাজ করলে বাবা?
: কেন যে করলাম মা – তাইতো বলতে এলাম। তোর মা-র কত গুলো নোংরা দৃশ্য আমার অন্তরকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিলো। এগুলোই আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে পারলাম না মা। এ ছাড়া আর বিকল্প কোন উপায় ও আমার জানা ছিলোনা।
: তা হলে কী তুমি স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করনি?
: না।
: তবে?
: এর উত্তর আমি অন্য একদিন দেব – মা। আজ থাক। এ বলে ছায়া মূর্তিটি শূন্যে মিলিয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মিষ্টি।
আজ কামনার বাসর শয্যা। সারা দিন খেটে খুটে কী সুন্দর করে পালঙ্কটি সাজিয়েছে কামালের ছোট বোন রীতা। যেখানে যে ফুল শোভা পায় সেখানেই তা গুজে দিয়েছে। পালঙ্কটি যেন এক অপরূপা নব মালঞ্চ। রীতার রুচি আছে, বলতে হবে। যে দেখে সেই রীতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে রীতা ভাবছে, কিছুক্ষন পরই, ভাই-ভাবীর উষ্ণ নিশ্বাসে সতেজ ফুল গুলো নিস্তেজ ঝরে পড়বে মাটিতে। কী এক অজানা ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় মুচকি হেসে এস্থান পরিত্যাগ করে রীতা। যথা সময়ে কামনা বাসরে এসেছে। বাসরের এক কোনে বসে, অভিনব সাজ সজ্জায় সজ্জিত বাসরটি দেখে তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো। সব মেয়েরাইতো অমন একটা দিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনে। একটু আগেও রীতা অমন একটা অনাগত দিনের প্রত্যাশায় মুচকি হেসে আনন্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তবে কামনা কেনো অমন একটি মধুময় রজনী পেয়েও অশ্রু ঝরাচ্ছে। কী ব্যথা তার মনে? কত কল্পনার জাল বুনতে বুনতে বাসরে প্রবেশ করল কামাল। কামনার চোখে জল দেখে অবাক হয়ে যায় সে। একী কামনা, এ সময় তোমার চোখে জল? এখনও কী পুর্ব স্মৃতি ভুলতে পারনি তুমি? ভুলতে পারনি সেই হারিয়ে যাওয়া লোকটির কথা? তাই যদি হয়, কেন আমায় ভালবেসে পূনঃ বিয়ে করলে? কেনো মিথ্যে অভিনয়ের জালে জড়িয়ে আমায় পাগল করলে? যে জন্য একটি লোককে আত্মহুতি দিতে হলো। একটি মেয়েকে হতে হলো সারা জীবনের জন্য পিতৃহীন। কী দরকার ছিলো এই নাটকের? এ নাটক না করলেও তো পারতে? চোখের জল মুছতে কামনা, কামালকে কাছে টেনে, “কেন এতো অবুঝ হচ্ছো কামাল, কে বলল আমি পূর্ব স্মৃতি স্মরিয়ে কাঁদছি আর এ-ও কী করে বুঝলে, একটি পিতৃহীন বালিকার জন্য কঁদছি। ড্রাগাশক্তি পুরুষটির জন্য কাঁদতে আমার বয়েই গেছে। কোন ভাগ্যের ফেরে সে আমার স্বামী হয়েছিল। আর কোন ফাঁকেই বা মেয়েটি গর্ভে এসেছিল বুঝতে পারিনি। ওদের জন্য কাঁদব দূরের কথা, স্বপ্নেও আমি ও কথা মুখে আনিনি।” তা যদি হয় – তোমার চোখে জল কেনো? “তা তুমি বলতে পারো? তুমি বিশ্বাস করো, আর নাইবা করো আমি কাঁদছি শুধু তোমার জন্যে। তুমি হলে তাজা ফুল। আর আমি? আমি হলেম বাসীফুল। বাসীফুল দিয়ে কেউ ফুলদানী সাজিয়ে সৌন্দর্য্য উপভোগ করে। তাই না?”- কামনা বলল। কী আজে বাজে বকছো তুমি, কামনা। এ কথা বলে একটি মধুময় রাত্রির মর্যাদা নষ্ট করে দিলে। কামনার ঠোঁটে ম্লান হাঁসি ফুটিয়ে, “রাখোতো এসব কথা”। তোমার মত অমন একটি হেন্ডসাম যুবক কেন আজ বাসী ফুলের সুবাস নিতে চাচ্ছো? পারতেনা কী একটি তাজা ফুলের ঘ্রান নিয়ে জীবনটাকে ধন্য করতে, গড়তে পারতে একটি সুন্দর সুখময় জীবন। মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে পারতে। না পারবে এখন বন্ধু বান্ধবের নিকট মুখ দেখাতে, না পারবে সমাজে উঁচু গলায় কথা বলতে। তোমাকে আমাকে আঙ্গুল দেখিয়ে লোকেরা টিট্কারী মারবে। পারবে তা সহ্য করতে? কামালের মন পরীক্ষা করার জন্য আবলিলাক্রমে কামনা কথাগুলো বলে গেলো। দেখ কামনা, শরীরটা আমার গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী। এসব টিট্কারী আমাকে কাবু করতে পারবে না। তুমি আমার পাশে থাকলে আমি বিষ খেয়েও হজম করতে পারবো। তুমিই আমার সব ব্যাধির মহোঔষধ। এখনে আমার ভয় হয় কামনা, তুমি চাকুরীজীবী মানুষ। না আছে আমার চাকুরী বাকুরী, না আছে অর্থ-বিত্ত, রাজনীতি করি। এক পা সব সময় চৌদ্দ সিকের ভেতর থাকে। অর্থাভাব তো লেগেই আছে। কখন যে এভাবে আমায় পরিত্যাগকরে চলে যাও কে জানে? কামনাকে পরীক্ষা করার জন্য কামাল কথা গুলো হাঁসি হাঁসি মুখে বলতে থাকে। এ কথা গুলো শুনে ভীষন দুঃখ লাগলো কামাল, কামনা জবাব দেয়। তুমি যে বেকার তা জেনে শুনেই তো তোমায় ভালোবেসেছি। আযথা তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো? আমার বেতনের সব টাকাই তো তোমায় দিয়ে দেই। খরচের জন্য তোমার কাছে হাত পেতে নেই। কী, নেই নি? তা অবশ্য। দেখো কামাল, তোমার সুখ আমার সুখ। তোমার দুঃখে আমার দুঃখ। তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই সবসময়। তুমি আমার স্বর্গ। যথার্থই তুমি বলেছ। আমি মুসলমান ঘরের ছেলে। তুমি হিন্দুর দুলালি। এইটুকু ব্যবধান মাত্র। সমাজের কথা বলছিলে – সমাজ তো মানুষের গড়া। যা চালানো যায় তাই চলে। কোন হিন্দু যদি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করে, সে আমাদের সমাজে মর্য্যাদা লাভ করে অমন কী আল্লার দরবারেও। সে নিজে তো বেহেস্থে যাবেই উপোরুন্ত তার মা-বাবাকে ও বেহেস্থ নেবার সুপারিশ জানাতে পারবে আল্লার দরবারে। তোমার হিন্দু সমাজে কি আছে না আছে তা আমার জানা নেই। সত্যি কামাল, তোমার ধর্ম আমার খুবই পছন্দনীয়। আমার বাসার পাশে রোজ সকালে এক মৌলভী সাব তোমাদের পবিত্র গ্রন্থ তেলোয়াত করতেন। আমি তন্ময় হয়ে তা শুনতাম।
হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে। এলাকায় মুখ রোচক গল্প কাহিনী হয়ে বাতাসে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। হাটে, ঘাটে, মাঠে সর্বত্রই এ নিয়ে বলা বলি চলছে। কেহ বলছে ভালই কাজ করেছে। আবার কেহবা বলছে অমন একটা কাজ ওরা করতে পারলো? বাপ দাদার চৌদ্দ গোষ্টির নাম ডুবিয়েছে। নানা মনের নানা মত তো থাকবেই। বিয়ের পর কিছু দিন কামনা বাবার বাড়ী অবস্থান করেছিল। ফলে হিন্দু সমাজে বাবাকে এক ঘরে করা হয়েছে। একটা বড় রকমের ভোজ পর্ব দিলে বাবাকে সমাজপতিরা আবার জাতে ওঠান। এ লজ্জা ঘৃনায় কামনার বাবা ধুকে ধুকে ইহদাম ত্যাগ করেন। বাবার মৃত্যুতে কামনার মনে ভীষণ আঘাত লেগেছে। কিন্তু মুখ ফোটে কাউকে কিছু বলিছেনা। কারন এ মৃত্যুর জন্য কামনা নিজেই দায়ী।
ছায়া মূর্তিটি আসার পর থেকেই মিষ্টি, নানীকে সাথে রেখে ঘুমায়। আজ আমাবস্যার তিথি। নিকুষ কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে গেছে সারা পৃথিবী। গভীর রাতে হঠাৎ ঘরের ভেতর খট্ শব্দ ওঠায় নানীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখেন এক ছায়ামূর্তির আবির্ভাব। আবার মিষ্টির ঘরে এসেছ তুমি, কী চাই তোমার? জানতে চান নানী। আপনি জেগে আছেন, ভালই হলো। মিষ্টিকে জাগাবেন না। মিষ্টি আপনার এখানে আছে বলেই আপনাকে বলা। আপনার মেয়ে যেভাবে একিটা জীবন নষ্ট করেছে, মিষ্টি যেনো অন্য কারো জীবন এভাবে নষ্ট না করে এভাবে তাকে গড়ে তোলবেন, এ আমার মিনতি আপনার কাছে – এ বলে ছায়ামূর্তিটি শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পথে নানী পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
বিঃ দ্রঃ- “এই গল্পটি সম্পূর্ন কাল্পনিক। গল্পটিতে ব্যবহৃত নাম, ঘটনা বা চরিত্র কারো সঙ্গে আংশিক বা পুরোপুরি মিললে লেখক দায়ী নয়।”
[click here to download the story]
লেখক পরিচিতিঃ
এম. এ. হামিদ জিলু।
অবঃ স্কাউট শিক্ষক,
উত্তর কেন্দুয়া সরঃ প্রাঃ বিদ্যালয়।
কেন্দুয়া, নেত্রকোনা।